আপনি কি প্যাকেট দেখে জিনিস কেনেন না প্রোডাক্ট দেখে?
মানে? ধরুন, আপনি নারকেল তেল কিনবেন। আপনি কি তেলের গুণগত মান দেখে- অর্থাৎ এই তেলে আপনার মাথা ঠান্ডা এবং চুল লম্বা ও ঝরঝরে হবে কি’না সেটা বিবেচনা করে তেল কিনবেন, নাকি তেলের বোতলটি কতখানি সুন্দর ও আকর্ষণীয় তা দেখে তেল নির্বাচন করবেন? হাস্যকর মনে হচ্ছে? অথচ এই হাস্যকর কাজটিই আমরা করে থাকি অহরহ।
আমাদের যুগের একটি গুরুতর সমস্যা হোল বাহ্যিক সৌন্দর্যপ্রীতি। সুন্দর জিনিস সবার ভালো লাগে, লাগাটাই স্বাভাবিক, এতে দোষের কিছু নেই। এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তখনই যখন কোন বস্তুর মূল্যায়নে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইটেরিয়া হয়ে দাঁড়ায়, যখন এর তুলনায় আর সকল বিচার বিবেচনা সচেতনতা ব্যাকসিটে স্থান পায়। এই অতিরিক্ত সৌন্দর্যপ্রীতির কারণে আমরা অনেক দাম দিয়ে ভেজাল পটেটো চিপ্স কিনে বাচ্চাদের কচি মুখে তুলে দেই অথচ বাসায় ক’টা তাজা আলু কেটে তেলে ভেজে দেইনা, অনেক দাম দিয়ে লাল টুকটুকে আপেল কিনে আনি যদিও তার ভেতরটা হয় পঁচা পোকায় খাওয়া অথচ এর চেয়ে তিনগুণ পুষ্টিমানসম্পন্ন তাজা পেয়ারা অনাদরে পড়ে থাকে বাজারের ঝাঁকায়। খাঁটি জিনিসের মূল্যায়নের এই যোগ্যতা এবং মানসিকতার বিলোপ এখন আর কেবল বস্তুগত নির্বাচনের ক্ষেত্রেই সীমিত নেই বরং আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রেও আমরা শুধু বাহ্যিক দিক দেখে বিবেচনার ফলে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হই।
যেমন ধরুন, যখনই কোন ছেলে বা মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র বা পাত্রী দেখা হয়- কোন কিছু জানার আগেই প্রশ্ন আসে, মেয়েটি দেখতে কেমন এবং ছেলে কি করে? একটু ভেবে দেখুন তো, জীবনের বন্ধুর পথে পরস্পরের হাত ধরে চড়াই উৎরাই পেরোবার জন্য এর কোনটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? বৈজ্ঞানিক অবৈজ্ঞানিক জরীপসমূহের ফলাফলে দেখা যায় বৈবাহিক জীবনে সুখের ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের ভূমিকার আয়ু বড়জোর ছ’মাস থেকে একবছর। তারপরে সম্পর্ক টিকে থাকে স্ত্রীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট এবং গুণাবলীকে কেন্দ্র করে নতুবা স্বামীর সহনশীলতা এবং মানবিক গুণাবলীকে অবলম্বন করে । আপনারা কি কখনো দেখেননি পরীর মত সুন্দরী বৌটাকে একবছর দু’বছরের মাথায় মুটিয়ে, মেদবহুল চামড়া ঝুলে পড়ে অন্যরকম হয়ে যেতে? অথবা কালো বৌটিকে ফর্সা সুন্দরী হয়ে যেতে? চাকরী, ব্যাবসা, পয়সা? হতেও দেরী নেই, যেতেও দেরী নেই। অনেক বড়লোক মানুষকে মূহূর্তে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবার ঘটনা নিজ চোখে না দেখলেও শোনেননি বা জানেননা এমন মানুষ কমই আছে। জীবনে চলার জন্য অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য, কিন্তু শুধু পয়সা দিয়ে যদি ভালোবাসা কেনা যেত তাহলে পৃথিবীর সব বড়লোকরাই সুখী বিবাহিত জীবন যাপন করতেন- এটি যে বস্তুত ঘটেনা তার ভুরি ভুরি উদাহরণ তো আপনারা সবাই জানেন।
তাহলে ভাবুন আমরা কত ঠুনকো কতগুলো বিবেচনার ওপর আমাদের সুখ, শান্তি, স্বস্তি, সাফল্য, ব্যর্থতা, বাবামা আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব সন্তানদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখি!
আল্লাহ বলেছেন,
“আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।
নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। — [সূরা রূমঃ আয়াত ২১]“
তিনি আমাদের জন্য এমন সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন যার মাধ্যমে আমরা শান্তি স্বস্তি ভালোবাসা পেতে পারি যা আমাদের পার্থিব জীবনকে অর্থবহ করবে এবং পারলৌকিক জীবনকে করে তুলবে সম্ভাবনাময়। এখানে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহমর্মিতার মাধ্যমে দু’টি হৃদয়ের মাঝে সৃষ্ট বন্ধনের সাহায্যে শান্তি পাবার কথা বলা হয়েছে। তাঁর পক্ষ থেকে কিছু পেতে হলে তাঁর নির্দেশিত পথ অনসরণ করতে হবে তা বলাই বাহুল্য।
ইসলামের একটি মূখ্য নীতি হোল পর্দাঃ
“* মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।
* ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” — [সূরা নূরঃ আয়াত ৩০-৩১]
এখানে আগে পুরুষদের পর্দার কথা বলা হয়েছে, অতঃপর মহিলাদের। ইসলাম চায় যেন একটি মেয়ে কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের ওপর ভিত্তি করে বিবেচিত না হয়ে তার স্বীয় গুণাবলীতে উদ্ভাসিত হবার সুযোগ পায়। স্বাভাবিক অবস্থাতেই যদি একটি মেয়েকে তার গু্ণ দেখে বিচার করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয় তাহলে ভেবে দেখুন এতি বিয়ের ক্ষেত্রে এটি আরো কত বেশী গুরুত্বপূর্ণ! পুরুষদের দৃষ্টি সংযত করার ব্যাপারে যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তার মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হোলঃ পুরুষরা রঙ দেখে আকৃষ্ট হয় আর মেয়েরা আকৃতি দেখে। যেসব মেয়েদের গুণ আছে তারা নিজেদের সৌন্দর্য অ্যাডভার্টাইজ করে বেড়ায় না। সুতরাং পুরুষরা দৃষ্টি সংযত না করলে সেসব মেয়েদের দেখেই মুগ্ধ হবার সম্ভাবনা বেশী যাদের বাইরের সৌন্দর্যটাই সার। আর মহিলাদের নিজেদের সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখতে বলার মূল উদ্দেশ্য তাদের এই সমস্ত চিন্তা এবং বিবেকবর্জিত পুরুষদের থেকে রক্ষা করা।
আবু হুরাইরা (রা) হতে জানা যায়, রাসূল (সা) বলেছেনঃ
“A woman is married for four things, i.e., her wealth, her family status, her beauty and her religion. So you should marry the religious woman (otherwise) you will be a losers. (Volume 007, Book 062, Hadith Number 027).
কেননা একটি মেয়ে তখনই তার স্বামীকে সুখী করতে পারে যখন সে তার প্রতি বিশ্বস্ত হয়, তার সম্পদ এবং সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ করে- বছরের পর বছর এই কাজটি কেবল তখনই করা সম্ভব যখন মানুষ আল্লাহকে ভয় করে। ভালোবাসা ওঠানামা করে- তুচ্ছ বিষয়ে ঝগড়া হলেও পরস্পরকে অসহ্য মনে হয়। কিন্তু আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের কারণে ঐ সময়েও একজন মহিলা তাঁর সংসারের ক্ষতির কথা ভাবতে পারেন না। একজন ধার্মিক মহিলা নিজগুণে না হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বামী, শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজন, স্বামীর যাদের পছন্দ- সবার সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট থাকেন। আল্লাহর ভয়েই তিনি কেবল নিজেই যে ভালো থাকেন তাই নয় বরং স্বামীকেও অন্যায় হতে বিরত থাকার পরামর্শ এবং সহযোগিতা দেন। আমার এক ভাই বলেছিল, “আপা, আমি এমন মেয়ে চাই যে কেবল নিজে নামাজ পড়বেনা বরং আমাকে নামাজ পড়ার জন্য তাগাদা দেবে”। আপনারা এমন সুন্দরী বৌ কি দেখেননি যার চাহিদা পূরণ করার জন্য স্বামী ঘুষ খান আর তিনি স্বামীর কাঁধের ওপর পা রেখে বেহেস্তে যাবার স্বপ্ন দেখেন? এমন পুরুষও বিরল নন যারা নিজেরা দাড়িটুপি পরে সুন্দরী স্ত্রীকে প্রদর্শনীর সামগ্রীতে পরিণত করে রাখেন। এটিকে কি ভালোবাসা বা ন্যূনপক্ষে পারিবারিক সম্প্রীতি বলা যায়? সেই সুন্দর দিয়ে কি লাভ যা অন্তর পর্যন্ত বিস্তৃত নয়?
পাত্র নির্বাচনের ব্যাপারে রাসূল (সা) শিখিয়েছেন, দরিদ্র পাত্র ধনী পাত্র অপেক্ষা উত্তম যদি সে সৎ এবং নামাজী হয়। কেননা যে আল্লাহকে ভয় করবে সে আপনাকে ভালোবেসে না হোক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হলেও আপনাকে ঠকাতে পারবেনা। ভেবে দেখুন যদি আপনার স্বামী আপনাকে বাড়ী গাড়ী সম্পদে ভাসিয়ে রেখে অন্যত্র প্রেম করে বেড়ায়, আপনি কি সুখী হবেন? অথচ অনেক দরিদ্র পরিবারেও দেখবেন বাজার থেকে বড় মাছ এনে স্বামী স্ত্রী মিলে যখন গল্প করতে করতে কাটেন সেখানে প্রেমের উৎসব বয়ে যায়। টাকাপয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায়না। কারণ চাকরী পরিবর্তন করা যায় কিন্তু চরিত্র পরিবর্তন করা যায়না। একজন ভালো স্বামী আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রীকে সে সকল সুযোগ সুবিধা দেবে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে- শ্বশুরবাড়ীর সাথে, স্ত্রীর বন্ধুবান্ধবের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবে যাতে স্ত্রী খুশী থাকে।সে কখনোই স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যাবহার করবেনা যেহেতু সে জানে এর জন্য তাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
আজকাল দেখা যায় পাত্র পেঁচার মত হলেও পাত্রী চাই ফর্সা, সুন্দরী, লম্বা, স্বাস্থ্যবতী, শিক্ষিতা, নব্যরুচিশীলা, বড়লোকের কন্যা। কোথাও চরিত্রের বা স্বভাবের ব্যাপারটি গুরুত্ব পায়না। অসংখ্যবার দেখেছি রীতিমত চারিত্রিক সমস্যাগ্রস্ত মেয়েদের হটকেকের মত বিকিয়ে যেতে অথচ বুদ্ধিমতি, সচ্চরিত্র, সুন্দর স্বভাবসম্পন্না মেয়েদের বিয়ে হয়না। অনেক শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান ভাইকে জিজ্ঞেস করেছি, “আচ্ছা, আপনারা শুধু চেহারা দেখে এমন মেয়ে কি করে বিয়ে করেন যাদের এতটুকু বুদ্ধি বা ম্যাচুরিটি নেই যে আপনি দু’ছত্র কবিতা বললে সে তা উপলব্ধি করতে পারে?” অনেকে এড়িয়ে গিয়েছেন, আবার অনেকে সততার সাথে উত্তর দিয়েছেন, “এদের সহজে ডমিনেট করা যায় যা বুদ্ধিমতি মেয়েদের করা যায়না”। একটি বিয়ের উদ্দেশ্য কি বন্ধুত্ব হওয়া উচিত না স্বৈরাচার, তা আপনাদের বিবেচনায় ছেড়ে দিলাম। তবে যার সাথে মনের কথা শেয়ার করা যায়না, যে আপনার সুবিধা অসুবিধা বোঝার মত বিবেকবুদ্ধি রাখেনা তার চেহারা দেখে সব কষ্ট ভুলে থাকা যায় কি’না এটা গবেষণা করার মত বিষয়।
একইভাবে অনেক মেয়েকে দেখেছি শুধু ভালো চাকরী করে দেখে এমন পাত্রকে বিয়ে করতে যার সাথে কক্ষনো তার মানসিক কোন বন্ধন সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই। এমনই এক মহিলা বলেছিলেন, “জানো, আমি আমার ডাক্তার স্বামীর সাথে পঞ্চাশ বছর সংসার করেছি কিন্তু একটি দিনের জন্যও সুখী হইনি”। এভাবে একমাত্র জীবনটি কাটিয়ে দেয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত তা বিবেচনার বিষয় বটে!
যারা বিয়ে করে ফেলেছেন তারা সঙ্গীদের আভ্যন্তরীণ বিকাশে সহযোগিতা করে সুন্দর সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তুলুন আর যারা এখনো বিয়ে করেননি তারা বিয়ে করার সময় শুধু দৃষ্টি দিয়ে নয় অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। এই জীবনকে স্বর্গ বা নরকে পরিণত করা সিদ্ধান্ত আপনার হাতে- ভুল করবেন না।
– রেহনুমা বিনতে আনিস