নির্বাচিত পোস্টসমূহ
Home » আল- কোরআন » যাকাত কোন অনুগ্রহ নয়, বরং অধিকার

যাকাত কোন অনুগ্রহ নয়, বরং অধিকার

সকল প্রশংসা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের। আমরা আমাদের নফসের খারাপ দিক থেকে তাঁর সাহায্য প্রার্থণা করি এবং আমাদের খারাপ আমল থেকে আশ্রয় চাই। আল্লাহ্ যাকে হেদায়াত দান করেন কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর আল্লাহ্ যাকে বিভ্রান্ত করেন কেউ তাকে হেদায়াত করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত কোন সত্য মা‘বুদ নেই; তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।

ভূমিকা:
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূলভিত্তির একটি। যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া ইত্যাদি আর পারিভাষিক অর্থে, নির্দিষ্ট মালে (নেসাব পরিমান মালে), নির্দিষ্ট সময়ে (চান্দ্রমাস হিসেবে বৎসর পূর্ণ হলে), নির্দিষ্ট খাতে (কুরআনে বর্ণিত আটটি খাতে) ব্যয় করার জন্য নির্দিষ্ট অংশ আদায় করার নাম যাকাত।

কেউ দশতলায় আর কেও গাছতলায়, কেউ কাউকে চিনে না, ইসলাম এরকম কোন জীবনব্যবস্থা নয়। ধনী-দরিদ্র সকলে দৈনিক পাঁচবার সালাতে আসার মাধ্যমে একে অপরের সুবিধা-অসুবিধা জানতে পারবে আর একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে, এটাই ইসলামের সৌন্দর্য। ধনী (নেসাবের মালিক) ব্যক্তিদের উপর আল্লাহ্‌ যাকাতকে ফরজ করেছেন যাতে তারা আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ করতে পারে আর সমাজে ভাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়।

সম্ভবত পবিত্র কুরআনে এজন্যই আল্লাহ্‌ সালাত এবং যাকাতকে অনেক জায়গায় একই সাথে উল্লেখ করেছেন।

“তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবংযাকাতদাও। তোমরানিজের জন্যে পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছুকর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন।” [সূরা আল-বাক্বারাঃ ১১০]

বেশিরভাগ মুসলিম অধিক নেকীর আশায় রমাদান মাসেই যাকাত প্রদান করে থাকে, তবে অন্য সময়েও যাকাতের প্রচলন রাখা উচিৎ যাতে প্রয়োজনের সময় মানুষ যাকাত পেয়ে উপকৃত হতে পারে।

মূল বিষয়ের উপর আলোচনা
যাকাত আল্লাহ্‌ এর পক্ষ থেকে ফরজকৃত একটি ইবাদাত যা আল্লাহ্‌ এর নির্দেশ মতোই সম্পাদন করতে হবে। আল্লাহ্‌ ক্ষমতাধীন মুসলিমদেরকে মৌলিক যেসব কাজ সম্পাদন করতে বলেছেন, যাকাত তার মধ্যে একটি।

কুরআনে বলা হয়েছে, “তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত।” [সূরা আল-হাজ্জঃ ৪১]

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মানুষ আজ যাকাতের উদ্দেশ্যকে না বুঝার কারণে যাকাতের মত গুরুত্বপূর্ন একটি ইবাদাত নিয়ে তামাশা করছে। একদিকে ইসলামী রাষ্টব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই যাকাত আদায় করছে না আর যারাও করছে তারাও সঠিকভাবে সম্পদের হিসাব-নিকাশ না করেই কিছু শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে নিজেদেরকে দায়িত্ব থেকে মুক্ত মনে করছে। যাকাতের উদ্দেশ্য কিছু শাড়ি-লুঙ্গি আর টাকা বিলানোর নাম নয় বরং যাকাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকাত পাওয়ার যোগ্য (দেখুন সূরা তাওবাহ- ৬০) ব্যক্তিকে কর্মসংস্থান (যেমনঃ গরু কিনে দেয়া, দোকান দিয়ে দেয়া, রিকশা কিনে দেয়া ইত্যাদি) সৃষ্টি করে দেয়া যাতে এই বছর যাকে যাকাত দেয়া হচ্ছে পরবর্তীতে তাকে আর যাকাত দেয়া না লাগে।

রমাদান মাসে মার্কেটে গেলে কাপড়ের দোকানে চোখে পড়ে “এখানে যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি পাওয়া যায়”। ভাবখানা দেখে মনে হয়, আল্লাহ্‌র সাথে এসব সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীদের contact হয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)। আর সমাজে একদল সস্তা মাতবর আছে যারা নেতৃত্ব আর বাহবা পাওয়ার আশায় ঈদের দুই-একদিন আগে তড়িঘড়ি করে শাড়ি-লুঙ্গি আর টাকা বিলানোর খেলায় মেতে ওঠে। ব্যাপারটা শ্রমিক তার মালিকের কথা ছাড়াই টাকা খরচ করার মত। আসলে যাকাত কোন অনুগ্রহ নয় বরং এটি ধনীদের মালে দরিদ্রদের অধিকারএবং আদায়যোগ্য সম্পদ।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক আছে।” [সূরা আয-যারিয়াতঃ ১৯]

মূলতঃ ইসলামের শুরুর দিকে গরীবদের দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করার এটিও একটি কারণ। তৎকালীন জাহেলী যুগে গরীবরা ধনীদের থেকে টাকা নিয়ে সে টাকা আদায় করতে না পারায় চক্রবৃদ্ধি আকারে সুদের বোঝা তাদের মাথায় এমনভাবে চেপে বসেছিল যে তাদের মুক্তির কোন পথ খোলা ছিল না। মানুষ যখন এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথের জন্য অপেক্ষা করছিল তখন মানবতার কান্ডারী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে মুক্তির পথের দিশা দিলেন, “এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক আছে”।

অন্যদিকে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) যেদিন মদিনায় রাষ্টগঠন করে বায়তুল-মাল (যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা) গঠন করেছিলেন সেদিন তিনি (সঃ) ঘোষণা দিয়েছিলেন, “মু’মিনদের মধ্যে যে কেউ ঋণ রেখে মারা যাবে, তা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার-ই। আর যে ব্যক্তি সম্পদ রেখে যাবে, তা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে।” [সহীহ বুখারী, ফারায়েজ অধ্যায়]

খুলাফায়ে রাশেদীন ও তার পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের ফলে মুসিলিম বিশ্বে যাকাত নেয়ার মতো লোক পাওয়া বেশ দুরুহ হয়ে পড়েছিল।

এগুলো হল যাকাতের সুফল যা সমাজে শান্তি নিয়ে আসে আর এর চেয়ে উওম প্রতিদান তো আল্লাহ্‌ই দিবেন।

আমরা যাকাত আদায় করলে বা না করলে আল্লাহ্‌ কোন লাভ বা লোকসান নেই, লাভ বা লোকসান দুটোই আমাদের। ধন-সম্পদ আল্লাহ্‌ এর একটি অনুগ্রহ। তিনি এর মাধ্যমে আমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান।

তবে কিছু লোক থাকে যারা যকোন ব্যাপারে অন্যের দ্বারস্থ হতে চায়, এরকম অভ্যাস পরিবর্তন করা জরুরী। রাসূলাল্লাহ (সাঃ) বলেন, “উপরের হাত নীচের হাত অপেক্ষা উত্তম।উপরের হাত দাতার, আর নীচের হাত ভিক্ষুকের।” [সহীহ বুখারী, যাকাত অধ্যায়]

এবার অন্য একটি প্রসঙ্গে আসা যাক,
কুরআন ও সুন্নাহে অনেক জায়গায় যাকাতের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ্‌ বলেছেন, “তোমরা আল্লাহকে উত্তমঋণদান কর।” কিছু লোক মনে করে আল্লাহ্‌ হয়ত অভাবী, নইলে তিনি কেন ঋণ চাচ্ছেন?

আল্লাহ্‌(সুবঃ)এই কথাটিই কুরআনে তুলে ধরেছেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলেছে যে, আল্লাহ হচ্ছেন অভাবগ্রস্ত আর আমরা বিত্তবান!……”[সূরা আল-ইমরানঃ ১৮১]

আল্লাহ্‌ (সুবঃ) এরকম কথার জবাবদিয়ে বলেন, “হে মানবসকল, তোমরা সকলে আল্লাহর দরবারে ফকির। আর আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত। [সূরা ফাতিরঃ ১৫]

সুতরাং, আপনি এই ধারণ থেকে বেরিয়ে আসুন যে, আপনি দরিদ্রদের (বা আট শেণীর যেকাঊকে) বা আল্লাহকে সাহায্য করছেন, বরং আপনি যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আপনার সম্পদের হক আদায় করছেন।

যাকাত আদায় না করার শাস্তি
দুনিয়ার শাস্তি
বুরাইদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত চিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যখন কোন জাতি যাকাত আদায় না করে তখন আল্লাহ্‌ তাদেরকে দুর্ভিক্ষ আর অনাবৃষ্টিতে আক্রান্ত করেন”। [তাবারানী, ইমাম হাইসামি (রহঃ) বলেন এই হাদীসের সব রাবীই সিকাহ]

যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোঘণা
রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর ইন্তিকালের পর হযরত আবু বকর (রা) তাঁর স্থলে মুসলমানদের খলিফা নিযুক্ত হলেন তখন আরবে কিছুলোক যাকাত দিতে আস্বীকার করলে আবূ বকর (রা.) বললেন,“আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি নামায ওযাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তার সাথে লড়াই করবো। কারণযাকাতহচ্ছে সম্পদের হক। আল্লাহর কসম, তারা যদি আমাকে উটের একটি বাচ্চা দিতেও অস্বীকার করে যা তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট দিত, তবে আমি তাদের এ অস্বীকৃতির জন্য তাদের সাথে লড়াই করবো।” [সহীহ বুখারী]

আখিরাতের শাস্তি
“সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার।”[সূরা আত-তাওবাহঃ ৩৫]

যাকাত আদায়ের সুফল
আল্লাহ্‌ (সুবঃ) এর পক্ষ থেকে প্রকৃত মুমিন হওয়ার গ্যারান্টি

“সে সমস্ত লোক যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। তারাই হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদেগারের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুযী।” [সূরা আল-আনফালঃ ৩-৪]

যাকাতদাতার জান-মালের পরিশুদ্ধি
“তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। আর তুমি তাদের জন্য দোয়া কর, নিঃসন্দেহে তোমার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ। বস্তুতঃ আল্লাহ সবকিছুই শোনেন, জানেন।” [সূরা আত-তাওবাহঃ ১০৩]

যাকাতদাতার মাল বৃদ্ধি পায়
আল্লাহর বাণী, “যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত,যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল,সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-বাক্বারাঃ ২৬১]

“এমন কে আছে যে, আল্লাহকে ঋণ দেবে, উত্তম ঋণ; অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে।” [সূরা আল-বাক্বারাঃ ২৪৫]

আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ সাদকা করবে, (আল্লাহ তা কবূল করবেন) এবং আল্লাহ কেবল পবিত্র মাল কবূল করেন আর আল্লাহ নিজ ডান হাত দিয়ে তা কবূল করেন। এরপর আল্লাহ দাতার কল্যাণার্থে তা প্রতিপালন করেন যেমন তোমাদের কেউ অশ্ব শাবক প্রতিপালন করে থাকে, অবশেষে সেই সাদকা পাহাড় বরাবর হয়ে যায়।” [সহিহ বুখারী, যাকাত অধ্যায়]

শেষকথা
আসুন, যাকাত সম্পর্কে যথাযথ ইলম অর্জন করে যাকাত আদায় করি, দূর করি সব ভ্রান্ত ধারণা। আল্লাহ্‌ এর সন্তুষ্টির জন্য যাকাত আদায় করি প্রিয় সম্পদ সন্তুষ্টচিত্তে। মনে রাখবেন, ইসলামের সেই সোনালী দিন আবার ফিরে আসতে পারে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে (ইন-শা-আল্লাহ্‌)।

Did you like this? Share it:

About কিতাবুল ইলম

রাসুল সাঃ বলছেন, "প্রচার কর, যদিও তা একটি মাত্র আয়াত হয়" সেই প্রচারের লক্ষে আমরা। 'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক' প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

Leave a Reply