নির্বাচিত পোস্টসমূহ
Home » আল- হাদীস » মদীনা শরীফ জিয়ারতের ফজিলত

মদীনা শরীফ জিয়ারতের ফজিলত

পবিত্র হজ্ব উপলক্ষে নবীর দেশে আগমনকারী একজন মুমিনের কর্তব্য হলো আগে বা পরে অন্তত একবার প্রিয় নবীর শেষ- শয্যার পাশে গিয়ে তাঁকে সম্বোধন করে সালাত ও সালাম পেশ করা। তাঁর সাথে সাক্ষাত করা হাজীদের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ বা বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত একটি কাজ। এটি হাজার বছর ধরে অনুসৃত একটি ইসলামী ঐতিহ্য। মহানবী (স.) এর যিয়ারত বা দর্শন এখানে হয়ে থাকে বলেই আমরা বেহেশতের একটি বাগান ”রওদাতুম মিন রিয়াদিল জান্নাতে” তাঁর অবস্থানে গিয়ে বলে থাকি আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ্! হে আল্লাহর রসূল! আপনার প্রতি সালাত ও সালাম নিবেদন করছি। পরম শ্রদ্ধার মোড়কে গভীর ভালোবাসা ও অভিবাদন জ্ঞাপন করছি। তিনি যেয়ারতকারীকে দেখেন এবং তার সালামের জবাবে তাকেও “ওয়া আলাইকুমস্ সালাম” বলেন। এখানে এক পক্ষ না দেখলেও ওদিক থেকে প্রিয় রসূল যেয়ারতকারীকে দেখে থাকেন। তিনি তার নাম, তার বাপ-দাদার নামও তখন স্মরণ করেন। এ জন্যেই এই দর্শনকে যেয়ারত বলা হয়।

অবশ্য, কেউ কেউ বলেন, যেয়ারত হজের অংশ নয়। যেয়ারত না করলেও ফরজ হজ্ব আদায় হয়ে যাবে। কথাটি ঠিক। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যিয়ারতকে নিরুত্সাহিত করা। অথচ মহানবী (স.) বলেছেন, মান্-হাজ্জা ওয়া লাম্ ইয়াযুরনী ফাকাদ জাফা-নী- “যে হজ্ব করল অথচ আমার যিয়ারত করলো না, সে আমার সাথে রূঢ় ব্যবহার করল।” আল্লামা ইবন হাজার আসকালানী (রহ.) বলেছেন এটি মহানবী (স.)-এর পক্ষ থেকে সতর্কবাণী। এ কারণেই ইমাম সুবকী বলেছেন, মহানবীর যেয়ারত সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম মিল্লাতের ঐকমত্য বা ইজমা হয়েছে (দেখুন, ফাতাওয়া শামী ৪ : ৫৪-৫৫ ও লাইলুল আওতার ৫:১০৪)।

উপরিউক্ত হাদিসটি বিভিন্নসূত্রে বর্ণিত। সিহাহ সিত্তার বাইরেও ইবনুস্-সিন্নী, ইবন আদী, দারাকুতনী প্রমূখ হাদীস সঙ্কলক তা সঙ্কলন করেছেন। হজ্বের সময় যেয়ারতের কথা বলা হয়েছে একথা বুঝানোর জন্য যে, এতদূর থেকে যখন মক্কা পর্যন্ত এসে হজ্ব করলে তখন যার উসিলায় তা পেয়েছে সে নবীকে এত কাছে এসেও সালাম না দিয়ে যাওয়া তো রূঢ় আচরণেরই শামিল। না হয় যেয়ারতের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। মহানবী (স.) বলে গেছেন ”মান্-যা-রা কাবরী বা’দা মাউতি ফাকান্নামা যা-রানী ফী হায়াতী। “যে আমার ওফাতের পর আমার কবর যেয়ারত করলো সে যেন আমার জীবনকালেই সাক্ষাত্ করল।” সুবহানাল্লাহ্! এ কত বড় সৌভাগ্য! কত বড় সুসংবাদ। যারা ঈমান অবস্থায় মহানবী (স.) এর সাহচর্য পেয়ে ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তারা তো সাহাবী। আর আমরা যারা যেয়ারত করেছি তারা সাহাবী হব না, কিন্ত তাঁর জীবনকালে শুভ দর্শনের মত এক বিরাট মাহাত্ম্য লাভ করবো, এতে সন্দেহ কী। ইব্ন আসাকের অন্য একটি সনদে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন।

যিয়ারত প্রসঙ্গে আরেকটি বিখ্যাত হাদীস হচ্ছে- মান্ যা-রানী ওয়াজাবাত লাহূ শাফা’আতী। “যে আমার কবর যিয়ারত করলো, আমার শাফা’আত তার জন্য অবধারিত হয়ে গেল।” এ হাদীসটিও সহীহ ও বিভিন্নসূত্রে বর্ণিত।

তবে ইতোমধ্যে নিজেরা মহানবী (স.)-এর যেয়ারত করেছেন, এমন কিছু লোক অন্যদেরকে পরামর্শ দেন যে, ওখানে যাবার দরকার নেই। এটি হজ্বের কোন অংশ নয়। প্রমাণ স্বরূপ তারা একটি হাদীস উল্লেখ করে থাকেন, লা- তাশুদ্দুর রিহাল ইল্লা ইলা ছালাছাতে মাসাজিদ। “তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদে যানবাহন ব্যবহার করে যাবে না। এ কথার অর্থ: সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আলেমগণ বুঝেছেন যে, কাছের মসজিদ ছেড়ে অন্য মসজিদে যাওয়া।

শত শত বছর পার হয়ে যাবার পর ইবন্ তাইমিয়া নতুন একটি কথা বললেন যে, কারও কবর যেয়ারতেও যাওয়া যাবে না। অথচ হাদীসে যেয়ারত করার কোন বাধা আসেনি। মানুষ কি তিন মসজিদ ছাড়া বাজারে, মাযারে, বিবাহ-শাদীতে কোথাও যেতে পারবে না! কাজেই যে কথা হাদীসে নেই ওহাবীরা কষ্টকল্পিতভাবে সে কথার ব্যাখ্যা করে বলে থাকে যে, তিন মসজিদ ছাড়া যানবাহনযোগে যাওয়া যাবে না। এটি আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। বরং মহানবী (স.)-এর যেয়ারত একটি অত্যন্ত সওয়াবের কাজ এবং কৃতজ্ঞ উম্মতের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাবার একটি প্রকৃষ্ট উপায়। আমাদের দেশের হাজীরা কারও বিভ্রান্তিকে গ্রহণ করে না। তারা কেউ যেয়ারত করা ছাড়া দেশে ফিরে আসেন না।

মদীনা শরীফের প্রবেশের পূর্বেই এই মনোভাব দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে হবে যেন কোন বেআদবী না হয়ে যায়। মহানবী (স.) এর নিকট গিয়ে তার সুপারিশ নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা কবুল করার গ্যারান্টি দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন—

“যখনই মুমিনগণ নিজেদের ওপর কোন অবিচার করে বসবে, তখন যদি আপনার নিকট এসে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় এবং রসূলও তাদের জন্য ক্ষমার সুপারিশ করেন তাহলে তারা অবশ্যই আল্লাহকে তাওবা গ্রহণকারী দয়ালু হিসেবে পাবে” (৩ ঃ ৬৪)।

এ আয়াত বলা হয়েছে- যখনই যেকোন যুগের কোন মুসলিম পাপ করার পর তার কাছে আসবে তার তাওবা আল্লাহ কবুল করবেন, যদি মহান রসূলও তার জন্য ক্ষমা চান। এতে বুঝা যায় মহানবী সা. যেয়ারতকারীকে দেখেন, শোনেন, জানেন এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, তাকে দু’আ করেন। এজন্যই তাকে বলা হয় জীবিত নবী। বরযখে তাঁর একটি অনন্য জীবন সক্রীয় আছে। অপর এক হাদীসে তো তা আরও স্পষ্টভাবে আছে, “আমার দুনিয়ার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, তোমরা কিছু কাজ করে বস, এবং তোমাদের জন্য বিধান আসে। এবং আমার ওফাতও তোমাদের জন্য কল্যাণকর, তোমাদের আমল আমার নিকট উপস্থাপিত হয়। ভাল দেখলে তো আল্লাহর শোকর করি, খারাপ দেখলে তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।” এ হাদীসটি সহীহ (হাইসাম :মাজমা’, ৯:২৪, বায্যার, সুয়ূতী: আল খাসায়েস ২:২৮১)।

মহানবী (স.) এর রওদা যেযারত একজন মুমিনের সারা জীবনের লালিত প্রত্যাশা। হজ্বের সময় বিশেষ করে এ সুযোগটি আসে। যে কয় দিন মদীনা মুনাওয়ারায় থাকবেন প্রতিদিন অন্তত একবার যেয়ারতের চেষ্টা করবেন। আদবের সাথে মহানবী (স.)-এর সামনে এসে বিনীতভাবে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে বলবেন—

“আস্সালাতু আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ !

“আস্সালাতু আস-সালামু আলাইকা ইয়া নাবীয়্যাল্লাহ!

“আস্সালাতু আস-সালামু আলাইকা ইয়া হাবীবাল্লাহ!

এভাবে যত বার সম্বোধন করা যায়, করবেন। যেমন-ইয়া শাফীআল মুযনেবীন! ইয়া রাহমাতাল্লিল আলামীন! তারপর এক মিটার ডানে সরে সাইয়েদুনা আবু বাক্র (রা.) কে সম্বোধন করে বলবেন— আস্সালামু আলাইকা ইয়া আবা বাক্র! আস্সালামু আলাইকা ইয়া আওয়্যালা খালীফাতি রাসূলিল্লাহ! আস্সালামু আলাইকা ইয়া ছানি এছনাইন ইয হুমা ফিল গার! এরপর এক মিটার ডানে সরে সাইয়েদুনা উমার (রা.) কে সম্বোধন করে বলবেন- আস্সালামু আলাইকা ইয়া উমার আল ফারূক! আস্সালামু আলাইকা ইয়া ছানী খালীফাতে রসূলিল্লাহ! এরপর আল্লাহর কাছে মুনাজাত করবেন। তবে অবশ্যই রওদা শরীফকে পিছনে রেখে নয়। এটি বেয়াদবী হবে। কারণ, মহানবী (স.) তো পবিত্র কা’বারও কেবলা। তিনি কা’বার চেয়েও বেশি মর্যাদাবান। সংক্ষিপ্তভাবে এভাবে যেয়ারত শেষ করে অন্যকে জায়গা করে দেবেন। কারণ, হজ্ব মৌসুমে ভিড় থাকে। আশা করা যায়, মহানবী (স.) আপনার সালামের জবাব দিয়েছেন। সারাজীবন আমরা যেন সেই পবিত্র স্মৃতি ধরে রেখে জীবনের পথে এগিয়ে যাই। আমীন!

সংকলন- ড. আবদুল্লাহ আল মারুফ

Did you like this? Share it:

About কিতাবুল ইলম

রাসুল সাঃ বলছেন, "প্রচার কর, যদিও তা একটি মাত্র আয়াত হয়" সেই প্রচারের লক্ষে আমরা। 'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক' প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Twitter, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

Leave a Reply